সালমান শাহ্‌: ক্ষণজন্মা এক মেধাবী তরুণ মহাতারকা

লিখেছেন | মাসুদ রানা নকীব

এলেন, দেখলেন, জয় করলেন।

রাতারাতি খ্যাতি অর্জন করা কিংবদন্তির ক্ষেত্রে প্রচলিত এ কথা। কিন্তু চিত্রনায়ক সালমান শাহ্’র ক্ষেত্রে?

এলেন, দেখলেন, জয় করলেন আবার বড়ো অকালে চিরতরে চলেও গেলেন। পৃথিবীতে এত অল্প সময়ে খ্যাতির উচ্চ শিখরে এসে এভাবে চলে যাওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। তাই তাঁর এভাবে চলে  যাওয়া এখনো মানুষের মনে বিদ্ধ করে। চলে গেলেন তিনি। আর চলে গিয়ে বলে গেলেন তিনি ছিলেন অন্যদের চেয়ে অনেক ব্যতিক্রম এবং ক্ষণজন্মা এক মেধাবী তরুণ মহাতারকা।

আজ এই মহাতারকা সালমান শাহ্‌’র ৪৯তম জন্মদিন। 

যে মহাতারকার প্রতি এখনকার অনলাইন প্রজন্মেরও ব্যাপক আগ্রহ, উন্মাদনা দেখতে পাই। অথচ এদের অনেকের জন্ম হয়েছে সালমান শাহ্’র রহস্যজনক অকাল মৃত্যুর অনেক পর। তবুও তারা ইউটিউবে সালমান শাহ্‌ অভিনীত নাটক, সিনেমা দেখে। তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা ফ্যাশন সচেতনতা ও তাঁর নানা ধরণের স্টাইল দেখে।

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, গুগল এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর স্টাইলিশ লুকের অসংখ্য ভিউকার্ড, ছবি দেখে দেখেই এখনকার তরুণ-তরুণীরা নিজেদেরকে চিত্রনায়ক সালমান শাহ্’র ভক্ত বলে দাবি করেন। এবং তাদের ফেসবুক প্রোফাইল, কভার ছবিতেও প্রিয় এই নায়কের ছবি দিয়ে রাখেন। আর এভাবেই ক্ষণজন্মা এই নায়কের প্রতি তাঁর ভক্তদের আগ্রহ, উন্মাদনা ও ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।

চিত্রনায়ক সালমান শাহ্ এভাবেই তাঁর ভক্তদের অন্তরে অন্তরে চির অমর হয়ে থাকবেন এটাই সত্যি।

উজানতলির কথা

লিখেছেন | টোকন ঠাকুর

এক হারানো দেশের গল্প দেখতে পাই 'উজানতলি' স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিটিতে।

পশ্চিমবঙ্গের নগর কোলকাতার দুটি ছেলেমেয়ে সীমান্তের নদীপাড়ে এসে একটি নৌকা ভাড়া করে। তারা নদীর বাংলাদেশ-পাড়ে ঘুরতে যায়। এপার-ওপারের গল্প।

তাদের কাছে মোবাইল ফোন আছে, ল্যাপটপ আছে। তারা হয়তো ছবি নির্মাণের জন্যে লোকেশন রেকি করতে চায়। এবং আমরা দেখি যে, ল্যাপটপের মধ্যে আছে ঋত্বিক ঘটক, আছে ‘কোমলগান্ধার’। ফলত, নদীপাড়ে বিজন ভট্টাচার্য তার দরাজ আবেগী গলায় কম্পন তুলে ঠিকই ধরলেন, ”এপার পদ্মা ওপার পদ্মা রে, মাঝে জাগনার চর/ তারি পরে বইসা আছেন শিবু সওদাগর।’

উজানতলি – Ebby Tune
স্ক্রিপ্টরাইটার ও ডিরেক্টর । সোম চক্রবর্তী
ফিল্ম এডিটর | প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য
সিনেমাটোগ্রাফার । সুভাদীপ দে
প্রডিউসার । তমাল চক্রবর্তী
কাস্ট । শ্রীমতি চন্দনা চ্যাটার্জি; অভিরূপ ভট্টাচার্য; বৃষ্টি রায়
ব্যাপ্তিকাল । ২৬ মিনিট
ভাষা । বাংলা
দেশ । ভারত
মুক্তি । ২০১৪ (ভারত)

নৌকা চলে নদীতে, নৌকা চলে কাশবনের ভেতর দিয়ে। ভয়েসওভারে রাজকুমারির গল্প, দৈত্যের গল্প, রাজার গল্প বা সেই হারানো দেশের গল্প। যে-দেশ একটি হারানো দেশ। নদীর ওপরে আকাশে মেঘ, নানান রঙের মেঘ, নিচে কাশবন, নৌকা চলতে থাকে বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেষে।

উজানতলি চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য।

মাঝির কথা থেকে জানা যায়, করিমপুর, পেয়ারাডোবা, নয়ানজুলি, উজানতলি জলে ডুবে গেছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশে বন্যা চলছে। ক্ষেতের ফসল ডুবে গেছে।তো বাংলাদেশের অগণন মানুষের জীবন বিপর্যস্থ। উৎকণ্ঠা বাড়ে ছেলেমেয়ে দুজনের, বেশি উৎকণ্ঠিত দেখি আমরা তাকে, যিনি নৌকার আরেক যাত্রী, এক বয়স্কা নারী, যার বাড়িই একদা ছিল উজানতলিতে। সেই কোন কিশোরীকালে যে পিতার হাত ধরে ছেড়ে এসেছে উজানতলি। দেশভাগের আর্তি ফুটে ওঠে এইখানে, যাকে এপিক করে ধরে রেখেছেন ১৯২৫ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করা ও পরে রাজশাহীর পদ্মাপাড়ে বড় হওয়া ঋত্বিক ঘটক। এবং ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর ঘটক হয়ে গেলেন ভারতীয়, যদিও তার যমজ বোন প্রতীতি দেবী থেকে গেলেন কুমিল্লায়, ঢাকায়, বাংলাদেশে।

প্রতীতি দি প্রয়াত হলেন গতবছর, ৯৪ বছর বয়সে। যমজ ভাইবোন যে দুই দেশের নাগরিক হতে পারে, আমরা দেখলাম। ‘উজানতলি’ ছবিতেও কিশোর-কিশোরীর ছবি ধরা হয়েছে। ‘নেইম ওফ আ রিভার’ এ অনুপ সিং ধরেছেন তার মতো করে। কমলেশ্বর মুখার্জি ‘মেঘে ঢাকা তারা’তে ধরেছেন তার মতো। ‘উজানতলি’তেও আমরা দেখি, মায়াবী বাল্যকাল বাগানের গাছে গাছে দুলে দুলে উঠছে। দুলে উঠি আমরাও, দর্শক হিসেবে। ভালো লাগে। সত্যি, এ ছবির সিনেমাটোগ্রাফি কী সুন্দর। ছবির মতো সুন্দর।

ঋত্বিক ঘটকের যমজ বোন প্রতীতি দেবীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং কবি টোকন ঠাকুর।

দেশভাগের পর নদী সীমান্তরেখা হয়ে গেছে। নগর কোলকাতার কয়েকজন থিয়েটারকর্মী এসেছে নদীর পাড়ে, যার ওপারেই বাংলাদেশ বা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান। থিয়েটার দলের অস্থির ও বিষণ্ণ নির্দেশক, যুবক ভৃগু তাকিয়ে থাকে বাংলাদেশের গ্রামটির দিকে। দলের নতুন সদস্যা যুবতী অনুসূয়াকে ভৃগু বাংলাদেশের একটি গ্রাম দেখিয়ে বলে, ‘ওই যে আমাদের গ্রাম, ওখানেই আমাদের বাড়ি ছিল কিন্তু কোনোদিন আমি আর ওখানে পৌঁছতে পারব না। চরম এক হতাশার অতল থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারা দেশভাগের যাতনার আখ্যান বলে দেয় কয়েকটি সংলাপে। এই দৃশ্য আমরা পুনরায় দেখতে পাই ‘উজানতলি’র মধ্যে। ‘উজানতলি’ গ্রামের সেদিনের কিশোরী, আজ যিনি ভারতীয় এক বয়স্কা নারী, যিনি বলেন, ‘আমি না রইলাম ওই দেশের, না হইলাম এই দেশের’ তার এই কথার মধ্যে যে মর্মর ধ্বনি আছড়ে পড়ে আমাদের মনোজগতে, তার জন্যে দায়ী কে?

উজানতলি চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য শ্রীমতি চন্দনা চ্যাটার্জি।

নৌকাযাত্রী বয়স্কা নারীকে প্রশ্ন করে মেয়েটি, ‘আচ্ছা মাসিমা,আপনি কি এখনো এই দেশকে (ভারত) ভালোবাসতে পারেননি? এতদিন তো হয়ে গেল!’ নিজের দেশ ছেড়ে আসা বয়স্ক নারী বলেন, ‘ভালোবাসি এই দেশটারেও। এটা তো আমার পর ভুঁই।’ কিন্তু ছেলেটি এক কাঠি বেশি শ্লেষ মেখে প্রশ্ন করে, ‘এই দেশে এমন বন্যা হলে কানবেন এমন করে?’ মাসি উত্তর না দিয়েই নৌকা থেকে নেমে পড়েন। তখন ছেলেটি আবারও প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘কি হলো মাসিমা, উত্তরটা দিলেন না?’ হায়রে দেশভাগ!

উজানতলি চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য।

হিমালয় দুহিতা নদী ভারতের ভেতর দিয়ে এসে বাংলাদেশে পড়েছে। তারপর নদীগুলো চলে গেছে বঙ্গোপসাগরে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪ টি অভিন্ন নদী রয়েছে। গত ৭০ বছর ধরেই ভারত এই নদী-রাজনীতি অব্যহত রেখেছে। যেমন, ভারতীয় ফারাক্কা বাঁধের কারণেই বাংলাদেশের অসংখ্য নদী মরে মরুভূমি হয়ে গেছে। আবার বর্ষা মৌসুমে ভারত সব বাঁধ খুলে দেয়। এতে করেই বাংলাদেশ ডুবে যায়, বন্যা হয়। ‘উজানতলির মাসিমা তো এই রাজনীতি বুঝবেন না, বুঝবে ভারতীয় প্রশাসন, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলা রাজ্য সরকার। অথচ নদী প্রাকৃতিক। তারপরও ভারত এই দাদাগিরির রাজনীতি জারি রেখেছে, আর বাংলাদেশ বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিবছর। কাজেই উজানতলির মাসিমার চেয়ে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে ‘উজানতলি’ ছবির পরিচালককে। কিছুমাত্র বুঝবেন কি?

উজানতলি চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য।

এইখানেই ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে পশ্চিম বাংলার আর সব কবি-সাহিত্যিক-সিনেমাওয়ালার পার্থক্য। তিস্তা নদীর পানি বণ্টনেও সেই একই সমস্যা। আজ আর বলাও যাবে না, ‘তিতাস একটি নদীর নাম।’ আজ ‘তিতাস একটি বালিয়াড়ির নাম’ ভারতীয় অকল্যাণকর রাজনীতির কারণে। জানি না, কোনোদিন পশ্চিম বাংলা বা ভারতীয় কোনো শিল্পী বা পরিচালক এই রাজনীতি নোটিস করতে সমর্থ হবেন কিনা!

১৯২৫ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করা ও পরে রাজশাহীর পদ্মাপাড়ে বড় হওয়া ঋত্বিক ঘটক।

তারপরও ‘উজানতলি’র নির্মাতা সোম চক্রবর্তী কে ধন্যবাদ জানাই, এ কারণে যে, ‘উজানতলি’র নির্মিতির জন্যে। সেই নির্মিতি না হলে আমিই বা এই লেখা লিখতাম কী করে?

চলচ্চিত্র পরিবেশনা এবং বিপণন (পর্ব-০২)

লিখেছেন | খন্দকার সুমন

মাধ্যমিক বিদ্যা

চলচ্চিত্রের আঞ্চলিক পরিবেশনা এবং বিপণন নিয়ে কথা উঠলেই দু’টি আলোচনায় বিভক্ত হতে দেখেছি। একদল বলছেন, "আগে ভাল চলচ্চিত্র তবেই দেশে চলচ্চিত্রের বাজার তৈরী হবে"। আবার আর একদল বলছেন, "না, আগে ভাল পরিবেশনা এবং বিপণন ব্যবস্থা হলেই কেবল ভাল চলচ্চিত্র আসবে"। এই যে “ডিম আগে না মুরগী আগে” এমন 'বৃত্তে আটকা' আলাপে না থেকে চলচ্চিত্র পরিবেশনা এবং বিপণন নিয়ে আলাপ এগিয়ে নিতে চাই। কারণ এতটুকু কথা লিখতে লিখতেই বিশ্ব আরও কিছুটা এগিয়ে গেল।

এই ধারাবাহিক লেখার প্রথম পর্বে বলেছিলাম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনেক আগেই পেক্ষাগৃহে প্রদর্শনীর অধিকার হারিয়েছে বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই। আটের দশকে বিকল্পধারা চলচ্চিত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এদেশের সাধারণ দর্শকদের কাছে মুক্তদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র যা কিনা ব্যবসায়ী প্রদর্শকদের কথিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সাথে পরিচয় ঘটে। মুক্তদৈর্ঘ্য হচ্ছে সেই চলচ্চিত্র যা নির্মাণে নির্মাতা দৈর্ঘ্যকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং চলচ্চিত্রটি সত্যিকার অর্থে যে দৈর্ঘ্যে শেষ হওয়া উচিৎ ঠিক সেই দৈর্ঘ্যেই শেষ হয়।

এবার ইতিহাস থেকে বেড় হয়ে বর্তমান পেক্ষাপটে আঞ্চলিক পেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র পরিবেশনার বিষয়ে আসা যাক। প্রথমে জেনে নেয়া যাক কি কি প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের একটি চলচ্চিত্র পেক্ষাগৃহ পর্যন্ত পৌঁছায়।

বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনকে সরকারি এবং বেসরকারী ভাবে চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন বলা হয়। এই ফিল্ম ডেভেলপ বলতে মূলত একটি ল্যাব-এ কিছু রাসায়নিক কর্মকান্ড বুঝায়। যেখানে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ফিল্ম ডেভেলপ করা হত। “হত” বলতে এজন্য বলছি কারণ এখন আর ফিল্ম ডেভেলপ হয় না। ডিজিটাল সিনেমা ক্যামেরা বাজার দখলের পর ক্যামেরার ফিল্ম উৎপাদন কম্পানী গুলো ফিল্ম উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। তাহলে ফিল্ম না থাকলে ফিল্ম ডেভেলপ ল্যাব কোন কাজে আসে না। কিন্তু বিপদ হলো সিনেমার ফিল্ম ক্যামেরার একটি ফিল্ম ডেভেলপ করার ল্যাবের বঙ্গানুবাদ করা হল চলচ্চিত্র উন্নয়ন। সিনেমা ক্যামেরার ফিল্ম আর আর চলচ্চিত্র/সিনেমা/ফিল্ম/মুভি এক জিনিস নয়।

এই একটি ভুল অনুবাদের জন্য বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের উন্নয়ন বিষয়ে নানান অনধিকার চর্চা করে আসছে কর্পোরেশনটি।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের বাহিরে থেকেও যদি একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় তবে তা সেন্সর বোর্ডে সেন্সর সনদ নিতে গেলে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র কর্পোরেশনের ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ বা ছাড়পত্র সহ জমা দিতে হবে। যদিও তথ্য মন্ত্রণালয় অধীনের বাংলাদেশ সেন্সর বোর্ড যে আইন দ্বারা পরিচালিত সেখানে এমন কোন আইন নেই।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন থেকে ছাড়পত্র নিতে হলে দশ হাজার টাকা ফি জমা দিতে হবে। তারা জানতে চাইবে আপনি কে? আপনি কি প্রযোজক সমিতির সদস্য? এরপর আপনাকে প্রযোজক সমিতির সদস্য হতে সমিতিতে যেতে হবে। প্রযোজক সমিতিতে লক্ষাধিক টাকার ফি জমা দেয়ার পর প্রশ্ন আসবে এই চলচ্চিত্রের পরিচালক কি পরিচালক সমিতির সদস্য? এরপর আবার লক্ষাধিক টাকা দিয়ে পরিচালক সমিতির সদস্য পদের জন্য আবেদন করতে হবে। যদিও চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি দাবি করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের ছাড়পত্র নিতে কেবলমাত্র প্রযোজক সমিতিতে নিবন্ধিত হলেই চলবে। কিন্তু পরিচালক সমিতি বলছে তাদের সদস্য পদও নিতে হবে নইলে ছাড়পত্র দেয়া হবে না। পত্র-পত্রিকায় দুই সমিতির এমন বক্তব্য প্রায়ই পাওয়া যায়। উল্লেখ থাকে যে এগুলো কোনটিরই আইনগত ভিত্তি নেই। এগুলো সবই ফিল্ম ডেভেলপ করা একটি ল্যাবের বঙ্গানুবাদ চলচ্চিত্র উন্নয়ন বলার দখলদারিত্ব।

ধরে নিলাম সব কাগজ জমা দেয়ার পর ১৯৬৩ সালের চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ আইন এবং ২০০৬ সালের দি ফিল্ম সেন্সরশিপ (এমেন্ডমেন্ট) আইন পার হয়ে চলচ্চিত্রটি সেন্স বোর্ডের সনদ অর্জন করেছে।

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র পরিবেশনার আগে এতগুলো বিষয় বলার উদ্দেশ্য হল, তথ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে বাংলাদেশ সেন্সর বোর্ডের সনদ ছাড়া কোন চলচ্চিত্র পেক্ষাগৃহে প্রদর্শনী সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ। এখানেই শেষ নয় সনদ প্রদানের শর্তে রয়েছে যে যদি কোন জেলার জেলা প্রশাসক মনে করেন উক্ত চলচ্চিত্রটি তার জেলায় প্রদর্শিত হবে না তাহলে চলচ্চিত্রটির সেন্সর সনদ থাকার পরও আপনাকে তা মেনে নিতে হবে।

সেন্সর বোর্ডের সনদ প্রপ্তির পর চলচ্চিত্রটির প্রযোজক কে যেতে হয় চলচ্চিত্র পরিবেশকের কাছে। ব্যক্তিগত পরিচয় ছাড়া কোন সিনেমা হল মালিক সরাসরি প্রযোজকের কাছ থেকে চলচ্চিত্র নেয় না। তবে দেশের মাল্টিপ্লেক্স গুলো সরাসরি প্রযোজকদের কাছ থেকেও চলচ্চিত্র নেয়।

এই সকল আইনে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে বলেই এখনও অনেক গুরুত্বের সাথে মেনে চলা হয়।

গত ১৮ আগস্ট ২০১৯ তারিখে প্রযোজক-পরিবেশক সমিতি মিলে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে চলচ্চিত্র দেখানোর জন্য প্রজেকশন মেশিনের ভাড়া প্রযোজকগণ দিবেন না। তা এখনও বাস্তবায়িত না হয়ে থাকলে প্রজেকশন মেশিনের ভাড়াও প্রযোজকদের দিতে হয়। এরপর আছে বুকিং এজেন্ট। যাদের টিকিট প্রতি ৩ টাকা কমিশন দিতে হয়। একই দিনে প্রযোজক-পরিবেশক সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বুকিং এজেন্টদের কমিশনের টাকা প্রযোজকগণ দিবেন না।

তিন দশক আগেও বুকিং এজেন্ট বলে কিছু ছিল না এদেশের চলচ্চিত্রের বাজারে। তিন দশক আগেও সিনেমা হল মালিকদের সাথে প্রযোজক, অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং কলাকূশলীদের সম্পর্ক পরিবারিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সিনেমা হল মালিকদের উত্তরসূরিগণ এই সম্পর্কের দিকে তাদের আগ্রহ দেখায়নি। সিনেমা হল থেকে মূনাফা কমে যাওয়ায় কোথাও কোথাও সিনেমা হল পরিচালিত হতে থাকে উক্ত হলের কর্মচারীদের মাধ্যমে যাদের সাথে প্রযোজকদের সম্পর্ক গড়ে না উঠায় জন্ম নেয় বুকিং এজেন্ট নামে একটি দালাল চক্রের। যারা এক বা একাধিক সিনেমা হলের মালিকদের সাথে সম্পর্ক রেখে হল নিয়ন্ত্রণ করে। কথিত আছে, “এই বুকিং এজেন্টরা বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্রের নির্দিষ্ট তারকা ছাড়া অপরিচিত কোন অভিনয় শিল্পীদের চলচ্চিত্র প্রদর্শনেও বাঁধা তৈরী করে”।

উপরের ঘটনা প্রবাহে এতটুকু পরিস্কার বোঝা যায় যে মাত্র ১,৪৯,২১০ বর্গকিলোমিটার (প্রায়) আয়তনের একটি দেশে মুমূর্ষ অবস্থায় বেঁচে থাকা প্রায় ১২০টি সিনেমা হলে চলচ্চিত্র পরিবেশনা এবং বিপণন কতটা ব্যয় বহুল এবং কষ্টকর। আন্তর্জাতিক মানের একটি চলচ্চিত্রের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে পরিবেশনা এবং বিপণন এমন কঠিন এবং ব্যয় বহুল নয়। তাই তরুণ নির্মাতা এবং প্রযোজকগণ নিজ দেশের পরিবেশনা এবং বিপণনের চাইতে আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের আগ্রহ এবং চেষ্টা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। হয়ত আগামী এক দশকেই এর সুফল বাংলাদেশ পেতে শুরু করবে।

বাংলাদেশের আঞ্চলিক পরিবেশনা নিয়ে আরও অনেক বিষয় আছে যা একটি লেখায় যথেষ্ট ভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। শুধু এতটুকু না বললেই নয় জেলা শহরের সিনেমা হল গুলোর দর্শকের দেয়া ১০০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে প্রযোজক অনধিক ১৫ টাকা পায়। উপজেলার সিনেমা হল গুলো থেকে কত পায় আমার জানা নেই। ই-টিকেটিং সিস্টেম না থাকায় টিকিট সেলের সঠিক সংখ্যাও প্রযোজক পর্যন্ত আসে না। মাল্টিপ্লেক্স গুলো থেকে অনধিক ৩৫ টাকা পায়। তবে সফ্টওয়ার নিয়ন্ত্রিত টিকিটিং সিস্টেম হওয়ায় মাল্টিপ্লেক্স গুলো টিকিট সেল বিষয়ক কোন প্রকার তথ্য গোপন করার অভিযোগ এখনও পাওয়া যায়নি।

চলচ্চিত্র প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তিত হচ্ছে। ভেঙ্গে যাচ্ছে প্রচলিত সিনেমা  কাঠামো। তরুণ নির্মাতাদের পার্সনাল চলচ্চিত্রের দিকে বেশি ঝুকতে দেখা যাচ্ছে।

বিশ্ব চলচ্চিত্রের পরিবর্তনের সেই ছোয়া বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণেও চর্চা হচ্ছে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলচ্চিত্র দেখার আকাঙ্খার দর্শক এবং চলচ্চিত্র সংস্কৃতি থেকে আজন্ম বিচ্ছিন্ন থাকা একটি জাতি গোষ্ঠির বেশির ভাগ দর্শক এখনও প্রস্তুত নয় সেই চলচ্চিত্র গুলো দেখার জন্য।

হতে পারে একটি নির্দিষ্ট ভুখন্ডে হয়ত নতুন চলচ্চিত্রের দর্শক যথেষ্ট নয়। কিন্তু পুরো পৃথিবী জুড়ে এর দর্শক কম নয়। তাই চলচ্চিত্র পরিবেশনা এবং বিপণনে ভাবতে হবে বর্ডারলেস দর্শকদের নিয়ে। তবেই কেবল চলচ্চিত্রের মুনাফাসহ বিনিয়োগ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। (চলবে)

বাংলা সিনেমা সাবালক হবে না? (পর্ব-০১)

লিখেছেন | টোকন ঠাকুর

'আমাদের সিনেমা সাবালক হবেই না?' এই প্রশ্নও বেশ পুরনো হতে চলল। প্রশ্নের যথার্থ উত্তর আসেনি। এদিকে বাংলা সিনেমাও সাবালক হতে পারছে না, নাকি হতে চায় না?

কিম্বা এরকম কি অনুমান করা যায়, সিনেমার সাবালকত্ব কাকে বলে? সেটাই ধাবনে আসেনি, বাংলাদেশে? তাহলে সাবালকত্ব কি বিষয়? আমিও উত্তর সন্ধান করছি। এক অর্থে আমাদের সিনেমা কি এখনো স্কুল বা কলেজের 'ক্লাস পালিয়ে' শুধু অল্পবয়েসীদেরই দেখার বিষয় হয়ে থেকে গেল না? স্কুল বা কলেজের শিক্ষকের দেখার উপযোগী হলো? সমাজের নানান পেশার মানুষের দেখার পক্ষে বাংলা সিনেমা তার উপযোগিতা হারিয়েছে, নাকি সেভাবে তৈরিই হয়নি?

সমাজ বা পরিবার কাঠামোর ভেতরে সিনেমা কোনো জায়গা পেয়েছে, বলা যাবে? আজকে ক্রিকেট খেলা যেভাবে সামাজিক-পারিবারিক, লেখাপড়া-চাকরি-বাকরি বা যে-কোনোভাবেই বেঁচে থাকার যে-জীবন আমরা পার করছি একটি পচা ও গলিত রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে বসে, সেখানে সিনেমার স্পেস আছে? প্রচুর সিনেমা নির্মিত হতে থাকলে সিনেমা নাবালক থেকে সাবালকত্বের দিকে যেতেই পারত। সমাজ কাঠামো কি সিনেমা নির্মাণের পক্ষে?

মানুষের জন্যে রাজনীতি, মানুষের জন্যে অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদি। এবং মানুষের জন্যেই সিনেমা। রাজনীতি কি সিনেমার নিয়ন্ত্রণ চায় না? রিলিজনের রক্ষণশীলতা  কি সিনেমার পক্ষে থাকতে পারে?  যে দর্শক, মানুষের জন্যে সিনেমা, তার মরালিটির মধ্যে ‘সিনেমা দেখা খারাপ কিছু’ -এরকম ঢুকিয়ে দিতে থাকলে তা কি সামগ্রিকভাবে সিনেমা বিকাশের অন্তরায় হয়ে ওঠে না? আমরা ভালো সিনেমার পক্ষে থাকব আবার সিনেমার অন্তরায়গুলো আমলেই নেব না, তা কিভাবে হয়? আদিকাল থেকে মানুষ তার মুক্তির জন্যে কতকিছু করে যাচ্ছে। আর্ট সেই মুক্তির পক্ষে লড়াই জারি রেখেছে। সিনেমা বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন আর্ট।

জীবন-জীবিকা, মনে-মননে মুক্তির জন্যে সিনেমাকে অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগানোর সুযোগ অনেক বেশি। দুনিয়ার সিনেমা সেই দিকে গেছে, যাচ্ছে। সিনেমা সাবালক হচ্ছে, দূরে দূরে, অন্য দেশে। চিন্তায় প্রভাব বিস্তারকারী সিনেমা কত বেশি প্রয়োজন আজ! ছিচকে তরুণ-তরুণীদের উপযোগী সিনেমা হচ্ছে, হোক, আরো হোক। কিন্তু সমাজ বলতে নানান পেশার নানান বয়সের মানুষ, যেদিকে আমাদের সিনেমা ফিরে তাকানোর সময় পেল না! তরুণদের জন্যে মাদক সরবরাহ যদি দণ্ডনীয় অপরাধ হয়, তাহলে সিনেমার নাম করে উদ্ভট কাহিনীচিত্র কেন মাদক নয়? কেন আমাদের সিনেমা এখনো সাবালক হচ্ছে না?

বেশিরভাগ মানুষ আমাদের গরিব, আমরা জানি। এই যে ‘গরিব’ এটা তো একটা রাজনীতি; এই রাজনীতির কুশলীপনা নিয়ে যদি কেউ সিনেমা তৈরি করে, সেই সিনেমা রিলিজ পাবে? যাদের জীবন নিয়ে সিনেমা, তাদেরও কি উদ্ভট কাহিনীচিত্র দেখার অভ্যাস থেকে ফিরে নিজেদের জীবন দেখতে ভাল্লাগবে?

এই ‘লাগবে কি লাগবে না’ তা নিয়ে যে খুব একটা চর্চাও হয়েছে, তাও বোধ হয় বলা যাবে না। সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটা শুধুমাত্র বুকের মধ্যে স্বপ্ন পোষা কোনো তরুণের একক কাজ নয়। কবিতা লেখার সঙ্গে সিনেমা নির্মাণের এই বড় পার্থক্য যে, কবিতা একা লেখার বিষয়। সিনেমা একটি দলগত প্রচেস্টা।

পুজি ও প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া সিনেমা হয় না, কবিতা তালপাতায়ও লেখা যায়। তাই কবিতা পাঠকের সামনে নিয়ে যাওয়ার আগে সেন্সর বোর্ডে যায় না, সিনেমা যায়। কিন্তু সিনেমা যত মানুষের মুখোমুখি হতে পারে তার বক্তব্য নিয়ে, কবিতা তা পারে না। অন্য ভাষাভাষী মানুষের কাছে কবিতা অনুবাদ হয়ে পৌঁছানো যতটা দুরুহ, সিনেমার সেই বাধা সাবটাইটেল করলেই নেই। আগেই বলেছি, সিনেমা প্রভাবশালী মাধ্যম। তাই সেই প্রভাব খর্ব করার চিন্তাও জারি আছে নিয়ন্ত্রকদের।

এখন কথা হচ্ছে, কী আছে? কী নেই? আর কি প্রয়োজন? জীবন যেহেতু দ্বিতীয়বারের নয়, সব প্রতিকুলতার মধ্যেও বাংলা সিনেমাকে তার নাবালকত্বের অভিযোগ ঘোচাতে হবে। পুরো সমাজকেই অংশহ্রহণ করতে হবে বা করাতে হবে। নইলে ভালো সিনেমা হবে? (চলবে)

আলোকচিত্র: চলচ্চিত্র নির্মাতা আবিদ মল্লিক

পোস্টমাস্টার নিয়ে নেপাল ভ্রমণ (পর্ব-০২)

লিখেছেন | সুপিন বর্মন

যাত্রীদের প্রবেশের জন্য প্লেনটির সামনে এবং পিছনে দু'টি প্রবেশ পথ। ধীরে ধীরে যাত্রীরা সারিবদ্ধ হয়ে প্লেনের ওঠার সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। আমরাও একই ভাবে প্লেনের গর্ভে প্রবেশ করলাম। মনে হলো আমরা অন্য দুনিয়ার বাসিন্দা। কোন এক গ্রহের ভুগহ্বরে প্রবেশ করছি। আসন নম্বর দেখে নিজ নিজ আসনে বসে পড়লাম। সবাই কাছাকাছিই বসেছিলাম। প্লেনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য হঠাৎ একজন বিমানবালা পিছন থেকে কয়েকটি সিট সামনে, ঠিক জানালার পাশের সিটটাতে বসিয়ে দিলেন।

জানালার পাশে বসে মনটা খুশিই হল। মনে মনে ভাবলাম ছোট্ট জানালা দিয়ে অন্তত পুরো দুনিয়াটা দেখা যাবে। আমার ঘনিষ্টজনদের থেকে একটু দূরত্ব বাড়ল বটে। যাই হোক যে যার মত চুপচাপ বসে আছি। বাহিরে সেলফি তোলার সময় পাইনি তাই বন্ধু স্বজনদেরকে আমার প্লেনে ওঠার খবরটি জানানোর জন্য ভিতরে বসেই সেলফি তুললাম। এর মাঝেই ছিপছিপে লম্বা হালকা চেহারার একজন বিমানবালা সকলকে অনুরোধ করে নিজের সিট বেল্টটি বাঁধতে বললেন। কিভাবে বাঁধতে হয় তা স্পষ্টই বুঝতে পারলাম।

মনের ভিতর অজানা ভয়। আকাশে ওড়ার প্রথম অভিজ্ঞতা। ভয় তো লাগবেই আবার আনন্দও বটে। মোবাইলের ঘড়িতে তখন দু’টো বাজে। ঘড়ির কাটার মত টিকটিক করছে আমার হৃদপিণ্ড। এইবার প্লেনের শরীরে একটু হালকা ঝাঁকুনি লাগল। ছোট্ট জানালা দিয়ে দেখা গেলো প্লেনের এক সাইটের প্রপেলারটি ভনভন করে ঘুড়ছে। বিকট আওয়াজ মনে হল। ঠিক দু’মিনিট পরেই একটু নড়ে চড়ে উঠল প্লেনটি। একটু একটু করে ঠেলাগাড়ীর মত প্লেনটি এগিয়ে চলছে পিচঢালা মসৃণ রানওয়ের দিকে।

বিমানবালার অনুরোধে প্লেনের সিট পরিবর্তনের আগ মুহূর্তের ছবি।

রানওয়ে পৌঁছানোর পর কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে  ধীরে ধীরে গতি বাড়তে লাগল। এতগতি বাড়লো যেন বাহিরের চারপাশের সবকিছুই কুয়াশার মত আবছা মনে হল, ছোট্ট জানালা দিয়ে দেখতে লাগলাম অপলক দৃষ্টিতে, হঠাৎ গুমগুম শব্দে প্লেনটি উপরে উঠতে লাগল। কান তালি লাগার মত অনুভব করলাম। সকলের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস। ধীরে ধীরে প্লেন থেকে বাড়তে থাকলো ভূমির দূরত্ব। বাড়তে থাকলো প্লেনের গতি। নিমিষেই নীচের সবকিছু ছোট হয়ে গেল। বড়বড় বিল্ডিং এর ছাদ বেয়ে কেবল আকাশের মেঘগুলো ছুতে ছুটে চলছে আমাদের ইউএস-বাংলার এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট৷

পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক বারবার আল্লাহ বলে হাই তুলছে। আমি চুপচাপ তাকিয়ে আছি জানালায়। নীচে যতদুর দেখা যায় ততদূর দেখার চেষ্টা করলাম। পিঁপড়ের মতই মনে হচ্ছে সবকিছু। মনে হলো প্লেনটি কৌণিক সমান্তরাল ভাবে ক্রসিং সিস্টেমে উপরে উঠছে আর সে কারণে ছোট ছোট মেঘের স্তর ক্রস করতে ঝাঁকুনি লাগছে।

এখন আর নিচের কোনকিছু দেখা যাচ্ছে না সবকিছু ঘোলাটে ভাব অনেকটা কুয়াশাচ্ছন্ন। মেঘ নিচে রেখে উড়ছে প্লেনটি। কত উঁচুতে আছি তা জানিনা তবে মাঝে মধ্যেই ককপিট থেকে ক্যাপ্টেন লাউড স্পিকারে উচ্চতার কথা বলছেন৷

এখন আমরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬ হাজার ফিট উপরে। আকাশের  রং গাড় নীল, মেঘ গুলোকে এই নীলের মাঝে ঘন ধোঁয়ার কুন্ডলীর মত মনে হচ্ছে। এরই মাঝে একজন বিমানবালা একটি খাবার প্যাকেট দিয়ে গেলেন। সাথে জলের বোতল। পেটে ক্ষুধা আছে কিন্তু এডভেঞ্চারের কারণে তা অনুভব করছি না। আশে পাশে সকলকেই খাবার খেতে দেখলাম। পিছনে তাকিয়ে সুমন ভাই এবং বিধান দার দিকে নজর দিলাম। মুচকি হাসি হাসলেন। দুই হাতে থাম্বস-আপ দেখালেন। এইবার খাবার প্যাকেট খুলে দেখলাম চিকেন বিরিয়ানি, সাথে এককাপ মিষ্টি জাতীয় খাবার। নাম ঠিক জানি না। তবে পায়েসের মতই মনে হল। খুবই সুস্বাদু খাবারটি। শূন্যে বসে খাবার খাওয়ার দারুণ অভিজ্ঞতা, দারুণ স্বাদ! ক্ষুধার কিনার ভরে পেট এইবার ঠান্ডা হল।

মাঝে মাঝে প্লেনে ঝাঁকি লেগে ঝনঝন করে কেঁপে উঠে। ককপিট থেকে ক্যাপ্টেন স্পিকারে আবারও বললেন আমরা এখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৬ হাজার ফিট উপরে আছি।

প্লেনের জানালা দিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৬ হাজার ফিট উপর থেকে তোলা ছবি।

প্লেনের কাপুনির সাথে বুকের ভিতরটা ছ্যাৎ করে উঠে। বিমানটি উড়ছে কি স্থির আছে তা বোঝা যায়না বাহিরে না তাকালে। এখন জানালা দিয়ে সুন্দর মেঘ খন্ড দেখা যায়, একটু হালকা নীলের মাঝে ঘন ঘোলাটে মেঘ। দেখে মনে হয় যেন থরে থরে মেঘপুঞ্জ সাজানো। কার্পাস তুলার মত নরম শুভ্র। আহা যদি হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যেত। সূর্যের আলো এসে পড়েছে প্লেনের প্রপেলারের উপর। চকচক করছে প্রপেলারের পাখা। হঠাৎ বিমান যখন বামে কিংবা ডানে একটু হেলে যায় তখন মনে হয় এই বুঝি পড়ে গেলাম। ভয়ংকর অনুভূতি। আমি মনে মনে ইশ্বরকে স্মরণ করি। এভাবেই মেঘের উপর দিয়ে ছুটে চলে আমাদের প্লেন। ছুটে চলে আমার শিরা ও ধমনীর রক্ত প্রবাহ।

একটু পর আবারও স্পিকার থেকে  স্বর কানে এল।এবার ক্যাপ্টনের মত কর্কশ কণ্ঠ নয় বিমানবালা তার মিষ্টি কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন আমরা এখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩২,০০০ ফিট উপরে।

স্পিকারে মিষ্টভাষী বিমানবালা জানিয়ে দিলেন আমাদের ডানপাশে হিমালায় রেঞ্জ দেখা যাচ্ছে।

জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি। মনে হলো দূরে পর্বতের অনেক গুলো সারিবদ্ধ চূড়া রোদে চকচক করছে। স্পিকারে মিষ্টভাষী বিমানবালা জানিয়ে দিলেন আমাদের ডানপাশে হিমালায় রেঞ্জ দেখা যাচ্ছে। হিমালয় রেঞ্জের সব চেয়ে উঁচু শৃঙ্গটিই পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ  মাউন্ট এভারেস্ট। এভারেস্টের কথা শুনেই আমার দেখার আগ্রহটা দ্বিগুণ হলো। ভাগ্য ভাল যে বিমানের ডান পাশেই বসেছি। এই সেই এভারেস্ট যার কথা অনেকভাবে পড়েছি। আজ দূর থেকে হলেও তা দেখার সৌভাগ্য হল। রোদের কারণে শৃঙ্গ গুলোকে হলুদ কুসুম রঙের আর আশপাশে ছায়াবেষ্টিত তুষারে ঢাকা স্থান গুলোকে কাশফুলের মত দেখাচ্ছে।

মেঘের রাজ্যে ভাসছি এখন। নানান রঙের মেঘ। টিভি সিরিয়ালে পরীদের মেঘের রাজ্য যেমন, ঠিক তার চেয়েও বেশি! কি দারুণ সুন্দর! এখন মনে হচ্ছে সত্যি আমরা স্বর্গের দিকে যাচ্ছি। চারপাশে মেঘ, মেঘের গালিচার উপর দিয়ে চলেছি আমরা! এই পৃথিবীর মেঘের রাজ্য বাস্তবে যে এত সুন্দর তা প্লেনে না উঠলে জানতামই না।

প্রায় ঘন্টা খানেক হলো আমরা শূন্যে ভাসছি। এখন মেঘের মাঝ দিয়ে পর্বতের কুয়াশাছন্ন ঘন সবুজ-কৃষ্ণ চূড়াগুলো দেখা যাচ্ছে। নিচের দিকে তাকালে মনে হয় অগোছাল ভাবে বিছিয়ে রাখা সবুজ চাদর। কি সুন্দর প্রকৃতি! উঁচু নিচু বিভিন্ন রকমের সবুজ ও গেরুয়া রঙের পর্বত চূড়া কুয়াশার মত মেঘ ফুরে উঁকি মারছে। পর্বতের রাজ্য দেখে মনে হলো আমরা নেপালের সীমানায় পৌঁছে গিয়েছি।

একটু পরই  স্পিকারে জানান হল অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণ করব। একই ঘোষণায় সকলকে আবারও সিটবেল্ট বাঁধার অনুরোধ করা হল। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম ধীরে ধীরে নিচের ঘর-বাড়ি, পর্বত গুলো স্পষ্ট হল। দারুণ লাগছে এই পর্বতের রাজ্যকে। ক্যামেরায় কয়েকটা ক্লিক করলাম। যতই নীচে নামছি ততই গা ছমছম করছে। মনে হচ্ছে আমরা নীচে পড়ে যাচ্ছি। প্লেনের গতি যে প্রচন্ড ছিল তা এখন বোঝা যাচ্ছে৷ নিমিষেই সবকিছু চোখে পরিস্কার হয়ে গেল। প্রচন্ড গতিতে একটু হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু শহরের মাটি স্পর্শ করল আমাদের প্লেন।

(চলবে)

জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম ধীরে ধীরে নিচের ঘর-বাড়ি, পর্বত গুলো স্পষ্ট হল।

পোস্টমাস্টার নিয়ে নেপাল ভ্রমণ (পর্ব-০১)

লিখেছেন | সুপিন বর্মন

ডিসেম্বর ২০১৭, বগুড়া। শীতকাল, এই সময় সকালে সূর্যের আলোয় সবুজ ঘাসের উপর চকচক করে শিশির বিন্দু। আবার দিনের বেশির ভাগ সময় কুয়াশার চাদরে মুড়িয়ে থাকে উত্তর জনপদের গ্রাম এবং শহরের উঠোন।

ঠিক এমনই এক কুয়াশা মাখা সকালেই একটি বার্তা আসে সুদূর নেপাল থেকে। ই-মেইলে লগ ইন করা মাত্রই পেলাম “নেপাল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব”-২০১৮ এর অভিনন্দন বার্তা। জ্বি! আমার নির্মিত প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পোস্টমাস্টার “নেপাল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব”-এ প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হয়েছে।

ই-মেইলের এই বার্তাটি আমাকে এত বেশী আনন্দিত করছে যে তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়! হিমালয় কন্যা নেপালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা শুনে শুনে নেপাল ভ্রমণের একটি সুপ্ত স্বপ্ন মনের গভীরে তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল। সেই স্বপ্নের দেশে আমার নির্মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে, ভাবতেই কি যে আনন্দ লাগছে তা বলে কিংবা লিখে বোঝানোর কোন শব্দ আমার জানা নেই। এই উৎসবে বাংলাদেশ থেকে ২টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা খন্দকার সুমন ভাইয়ের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অঙ্গজ এবং আমাদের পোস্টমাস্টার । সুমন ভাই আমার পূর্ব পরিচিত হওয়ায় প্রথমেই ওনাকে ফোন দিলাম, উৎসবে চলচ্চিত্র নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি অবগত হয়ে তিনি আমাকে অভিনন্দন জানালেন, আমিও তাঁকে অভিনন্দন জানালাম। এরপর পোস্টমাস্টার  চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের মাঝে আনন্দ বার্তাটি ছড়িয়ে দিলাম।

পার্কিং লাইনে সারি সারি দাঁড়িয়ে ছোট, বড়, মাঝারি নানান সাইজের প্লেন।

দারুণ এক অনুভূতি! দেশের বাহিরে এই প্রথম আমার চলচ্চিত্র নির্বাচিত হল। এতদিন শুধুই ভাবতাম কখনও আমি যদি চলচ্চিত্র নিয়ে দেশের বাহিরে ঘুরতে পারতাম, তাহলে কতই না মজা হত। ঠিক এই রকম মজার খবরটি দু’দিন পর সুমন ভাই জানালেন আমাকে। তিনি ফোন দিয়ে জিজ্ঞাস করলেন আমি নেপালে যাবো কিনা, যাওয়ার ইচ্ছা আছে জেনে তিনি দারুণ দারুণ সব অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করলেন আমার সাথে। ২০১৭ সালেও তিনি নেপালে গিয়েছিলেন তাঁর প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পৌনঃপুনিক  নিয়ে। তাই আগে থেকেই আমাকে কিভাবে কি করতে হবে সেই সব বিষয়ে জানালেন। আমি নেপালে যাব ভেবে দারুণ অপেক্ষায় কাটতে লাগলো সময়।

ঠিক জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই উৎসব কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণপত্র চলে এলো। এদিকে পোস্টমাস্টার চলচ্চিত্রের মুখ্য অভিনেতা বিধান রায় সফর সঙ্গী হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করলেন, আমন্ত্রণ পত্রে উল্লেখ ছিল যে নেপালে ৩১ জানুয়ারি ২০১৮ থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত থাকা খাওয়া এবং লোকাল ট্রান্সপোর্টেশন সহ সকল সুবিধা তারা প্রদান করবে। উৎসব চলবে ২-৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ব্যাস আমন্ত্রণ পত্র পাওয়ার পর থেকেই চলতে লাগলো আমাদের প্রস্তুতি।

আমাদের উড়ানের সময় তারিখ চূড়ান্ত করে বগুড়া থেকেই ইউএস বাংলার টিকেট করলাম। খুব ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে সময় গুলো যেতে লাগল। নেপাল যাচ্ছি…! প্রস্তুতির একটা ব্যাপার স্যাপার আছেনা!  যাই হোক অপেক্ষার প্রহর প্রায় শেষ। ৩১ জানুয়ারি ২০১৮ দুপুর ১২.৩০ মিনিটে আমাদের ফ্লাইট তাই বগুড়া থেকে বিধান দাদাসহ ৩০ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

৩০ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে উত্তরায় প্রদ্যুৎ কুমার দাদার বাসায় নির্ঘুম রাত কাটালাম। না… না… বাসায় থাকার কোন অসুবিধা ছিল না। থাকার মত সব রকম আরাম আয়েসের আয়োজন ছিল, খাবার দাবার তো হুলস্থুল কারবার। এত কিছুর পরও রাতে ঘুম না হওয়ার কারণটি ছিল মানুষিক উত্তেজনা। এই প্রথম প্লেনে করে স্বপ্নের দেশ নেপাল যাচ্ছি, যদিও ইতোমধ্যে বেশ কয়েক বার ভারত সফর হয়ে গেছে আমার তবে তা কেবল বাস আর ট্রেনে করে। প্লেনে ওঠার মনোবাঞ্ছা তো সকলেরই থাকে তাই প্লেনে ওঠার রোমাঞ্চকর বিষয়টি কেমন হবে তা ভেবেই রাতটা এক রকম আধা ঘুম আধা তন্দ্রায় চলে গেল।

নীচে যতদুর দেখা যায় ততদূর দেখার চেষ্টা করলাম। পিঁপড়ের মতই মনে হচ্ছে সবকিছু।
সকাল হতে না হতেই আমার ডাকে ধরফর করে উঠলেন বিধান দা, তিনি এমনিতেই একটু হুজুগে মানুষ। ভেবেছিলেন আমার হয়ত কোন সমস্যা হয়েছে। পরে যখন বুঝলেন সকাল সকাল তৈরি হতে হবে তখন ঘড়ি দেখিয়ে বললেন, এখনও অনেক সময় আছে আরেকটু ঘুমাই বলে কাঁথা মুড়িয়ে আরেক দফা ঘুমানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু আমার তো আর ঘুম নেই। শুয়ে থেকেই সাতটা পর্যন্ত থাকতে হল বিছানায়। তারপর শুরু হলো বিমান বন্দরে যাওয়ার প্রস্তুতিপর্ব। সময় যেন যেতেই চায়না, আমার জোড়াজুড়িতে সকাল সাড়ে ন'টায় বের হতে হলো বিধান দা-কে। আমাদের সাথে স্কাউটস-এর নাজির ভাইও সফরসঙ্গী হলেন।

তিনজন মিলে উত্তরা থেকে সিএনজি করে সোজা এয়ারপোর্ট। এতদিন শুধু বাহির হতে চলন্ত গাড়ি থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেখেছি, আজ সোজা সেই বিমানবন্দরেই যাচ্ছি। কি দারুণ অনুভূতি। সকাল দশটায় বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম আমরা। বাহিরে বিশাল লাইন দাঁড়িয়ে। আমরাও দাঁড়ালাম ঐ কাতারে। প্রায় আধাঘন্টা পর আমরা বিমানবন্দরের অন্দরমহলে প্রবেশ করলাম।

পোখারা শহরের একটি মন্দিরের সামনে।

ঝলমলে চকচকে সবকিছু। চারপাশে দারুণ-দারুণ ফুডকোট। বিভিন্ন এয়ার ট্রাভেলস এর কাউন্টার অফিস। মনোযোগ দিয়ে ইউএস-বাংলার সাইনবোর্ড খুজছিলাম কিন্তু পেলাম না কারণ তখনও ইউএস-বাংলার কাউন্টার খোলেইনি, একটি বেঞ্চে বসে প্রায় আধাঘন্টা কেটে গেলো আমাদের। কিছু সময় পরে সুমন ভাইকে ফোন দেয়া মাত্রই তিনি সামনের একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে বললেন ইউএস-বাংলার কাউন্টারের সামনে দেখো। আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। এদিকে চলে এসো। ধরফর করে বিধান দাসহ সামনে তাকাতেই চোখে পড়লো চলচ্চিত্র নির্মাতা খন্দকার সুমন ভাইকে। আমার সাথে থাকা বিধান দা ও নাজির ভাইকে পরিচয় করে দিলাম সুমন ভাইয়ের সাথে। আমরাও পরিচিত হলাম অঙ্গজ  চলচ্চিত্রের প্রযোজক শরীফ-উল-আনোয়ার সজ্জন ভাইয়ের সাথে। ইউএস-বাংলার কাউন্টার থেকে বোডিং পাস সংগ্রহ করে ইমিগ্রেশন পার হই। সবাই  একত্রে এদিক সেদিক ঘুরে, চা নাস্তা সেরে ফ্লাইট কল টাইমের অপেক্ষায় বসে রইলাম।

ধীরে ধীরে সময় চলে যায়। ফ্লাইট টাইমের আধা ঘন্টা লেটে ঠিক দুপুর একটার সময় আমরা অন বোড হওয়ার জন্য প্রস্তুত হই। লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম সবাই। আমি ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। পূর্বের কোন অভিজ্ঞতা নেই তাই একটু আধটু ভয়ও কাজ করছে। একে একে সকলেই পাসপোর্ট, বডিং পাশ দেখিয়ে পরবর্তী সিকিউরিটি চেকআপের লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাতঘড়ি, বেল্ট, ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসসহ হ্যান্ড লাগেজ চেকআপ শেষ করে আমরা ঠিক দুপুর দেড়টায় অন বোর্ডের জন্য ওয়েটিং রুমে প্রবেশ করলাম। চোখ জুড়িয়ে গেল।

বিস্তীর্ন খোলা এলাকা, উপরে নীল আকাশে শুভ্র মেঘ। আকাশের উড়ন্ত ছোট্ট যানগুলো যে এত বড় বড় তা ওয়েটিং রুমে প্রবেশ না করলে বোঝাই যেত না। কি সুন্দর ঝকঝকে তকতকে পরিস্কার টার্মিনাল। প্লেন কোনটা ল্যান্ড করছে আবার কোনটা উড়ার জন্য অপেক্ষা করছে। খুব সুন্দর। পার্কিং লাইনে সারি সারি দাঁড়িয়ে ছোট, বড়, মাঝারি নানান সাইজের প্লেন, ঠিক যেন প্লেনের বাজার বসেছে। দেখতে দেখতে আমাদের অন বোড করার জন্য বাস চলে এলো। দুই/তিন মিনিট পরেই আমরা রানওয়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ইউএস-বাংলার এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নম্বর ২১১ কাছে চলে আসলাম। বাস থেকে নেমেই আবারও লাইন। জানিয়ে রাখি যে এই দিনের পর থেকে ঠিক ২২তম যাত্রা পথে এই ফ্লাইটটি ১২ মার্চ ২০১৮ তারিখে নেপালের কাঠমান্ডু ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়। ক্যাপ্টেন, কো-পাইলট সহ প্লেনের মোট ৫১ জন যাত্রী এবং ক্রু নিহত হন। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাই।

চলবে | পোস্টমাস্টার নিয়ে নেপাল ভ্রমণ (পর্ব-০২)

বিধ্বস্ত ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নম্বর ২১১
Tokon Thaakoor

সিনেমা কেন, কার জন্যে?

লিখেছেন | টোকন ঠাকুর

"পিজারোর মন যত না বাইবেলের দিকে, তার চেয়ে বেশি সোনার খনির দিকে" এ কথা হাভানায় বসে এক সাক্ষাতকারে বলেন ফিডেল কাস্ত্রো

কমাদান্তের বক্তব্য অনুযায়ী একদা পিজারো ছিলেন স্পেনীয় যাজক। তিনি বাইবেল হাতে করে স্পেন থেকে গমনে যান পেরুতে, মাচুপিচুতে। মাচুপিচুর স্থানীয়রা তো আদিবাসী। তাদের ধর্ম বিশ্বাস, জীবনযাপন-সংস্কৃতি , শস্য উৎপাদন যেমন, স্পেন বা ইউরোপীয় থেকে তা ভিন্ন। কিন্তু যাজক পিজারো আদিবাসীদের শোনান বাইবেলের বাণী।

মাচুপিচুর বাসিন্দারা বাইবেলের ঐশী ইন্দ্রজালে বোকার মতো অবাক হতে থাকে। ঐশী উপাসনার আদরে তাদের চোখ জুড়ে নেমে আসে ঘুম। তখন পিজারো কী করেন? পিজারো জেনে নিতে থাকেন মাচুপিচুতে কোথায় কোথায় সোনার খনি আছে। তারপর পিজারো ছুটিতে যান স্পেনে এবং কিছুদিন বাদেই মাচুপিচুতে আসে জাহাজভর্তি গোরা সৈন্য। তারা খুব সহজেই লুট করে নিয়ে যায় সোনা, খনি থেকে। পেরুতে এলো বাইবেল, চলে গেল সোনা। তাই কাস্ত্রো বললেন, “পিজারোর মন যত না বাইবেলের দিকে, তার থেকে বেশি সোনার খনির দিকে”।

সিনেমা কি দর্শকের চোখ ও কানের সামনে একধরনের বাইবেল হয়ে আসে? ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা পায়। প্রযোজক-পরিচালক-নায়ক-নায়িকা কত কী দেখা যায়। একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রী সুপারস্টার হয়ে যায়।

tokon-thaakoor

বুদ হয়ে থাকে দর্শক, কেন না তাদের সুপারস্টার ভাল্লাগে। কেন না দর্শকের মনোরম লোকেশন ভাল্লাগে। শত প্রতিকুলতার পরেও প্রটাগনিস্ট যেন জিতে যায়। এই স্বপ্ন নিয়ে টাকা খরচ করে দর্শক সিনেমা হলে যায়। যে-জীবন প্রায় যাপনই হয়নি, হয়তো দেখাও হয়নি, কিন্তু তার একটা রুপকথাময় ছবি হয়তো আছে মনে মনে; সে-রকম ছবিই যেহেতু ‘মেইন্সট্রিম’ আখ্যা পেয়েছে, সেই ছবিই তো সুপারস্টার কাস্ট ছবি। এতে বাণিজ্য হয়, হতেই থাকে। বাণিজ্য বলতে দর্শকের ঘাড়ে চড়ে কোটি কোটি টাকার মুনাফা নিশ্চিত করা। দর্শক সেই ফোকলা হাসি, দর্শক সেই হাড় জিড়জিড়ে, দর্শক সেই ছাপোষা। সিনেমা তাদের মনোরঞ্জন করে চলেছে। আর সেই ‘মেইন্সট্রিম’ এর লোকেরা কোটি টাকার মুনাফা নিয়ে অংক কষছে। ফলত এই বিরাট শিল্পমাধ্যমটি যতটা মুনাফা অর্জনের বিনিয়োগে ব্যস্ত, যতটা বাইবেল, যতটা ঐশী ন্যয়নীতিতে মনোযোগী। সোনার খনি লুটের চিত্র কিন্তু ততটা নয়।

কোটি কোটি মানুষ, যারা ‘মেইন্সট্রিম’ এর দর্শক, তাদের শাসিত ও শোষিত হবার ঘুম যেন কিছুতেই না ছোটে! রাস্ট্রযন্ত্রের চাকায় তারা পিষ্ঠ হবে, হতেই থাকবে। তারা পুজির ‘সুপারস্টার ‘ তৈরি করে তারপর টিকিট কেটে সেই স্টার দেখতে পারেন।

ইন্ডাস্ট্রি সেই দায়িত্বে মনোযোগী সবসময়। মাটি ফুড়ে অংকুরিত উদ্ভিদ চারার মতো প্রতিটি মানুষ যে অসীম সম্ভাবনাময়, সেই সম্ভাবনা আর বিকশিতই হয় না। ইন্ডাস্ট্রি তাই ফর্মুলাতেই মাথা ডুবিয়ে রাখে। দেশে দেশে এই ইন্ডাস্ট্রি সিস্টেমের বিপরীতে কিছু সিনেমা হয়, হচ্ছে, আগামীতেও হবে। কস্টকর হলেও হতে থাকবে। এটা হয়তো সবসময়ের লড়াই। রাজার সেনারা আসবে, জনপদের ফসল ও যুবতী ধরে নিয়ে যাবে। কিছু যুবক বিদ্রোহ করবে। রক্তাক্ত হবে, মারা পড়বে, চিরকাল।

তবু সিনেমা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা জারি আছে, জারি থাকবে। আজ সিনেমা যতটুকু স্বাধীন, আগামীতে সিনেমা আরো স্বাধীনতা লাভ করবে। কবিতা লেখার মতো স্বাধীনতা নিয়ে তার আত্মপ্রকাশ হবে। এইসবই ভাবতে থাকি করোনাপীড়িত সকালবেলায়…

tokon-thaakoor

Film Review | Postmaster

Writer | Dr. Sachin Ghimire

Taste a slice of heaven, and feel free to keep dreaming

Captivating drama unrolling in a soft flow, encircled by the fabulous nature of rural Bangladesh like a backdrop painting. The soundscape is interacting smoothly with the storyline.

Postmaster, a film directed by Supin Barman, reveals the two leading characters from two different worlds developing an exceptional emotional bond, building mutual levels of trust.

A young ambitious postmaster from the city and an illiterate orphan, sweet and vibrant, despite her sad past. The facial expressions of the postmaster are visualizing perfectly the tangible disappointment he feels in his new job. Slowly we see this turn into compassion for the orphan Raton. It is a joy to watch the regrowth of happiness in the heart of Raton, blooming out of the infinite void she got stuck in.

A highlight I want to mention is the sudden crushing pain that is heartfelt, when, unfortunately, the colourful soap bubble gets punctured by sudden rainfall, washing away all hopes and dreams.

The recall of memories, in black and white, are a mesmerizing cloud moulding to the final moment of goodbye. It is admirable to see her strength and courage to digest her bitter destiny, returning to nothingness once more.

One of the best things about this film is the special part of the old caretaker who gives the story a special dimension. I was impressed by his fascinating character. His compliance and effort to pleased his new postmaster is remarkable like his humble sympathy.

Fanning the importance of the post office, a deserted place, completely out of service. The hesitation and reluctance of the only letter that has to be delivered in months is the heartbreaking inner core of the film that is somewhat predictable. Still, phenomenally depicted.

A still from the short film "Postmaster"

Overall, according to me, this film has successfully captured universal human emotion.

চলচ্চিত্র পরিবেশনা এবং বিপণন (পর্ব-০১)

লিখেছেন | খন্দকার সুমন

প্রাথমিক বিদ্যা

চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রি-প্রডাকশনের অস্থিরতা, শুটিং-এর ঝড় আর সম্পাদনার টেবিলে ধর্য্যের পরীক্ষাই কি শেষ! না কি এরপর থেকেই শুরু?

সম্পাদনার টেবিলে একটি চলচ্চিত্রের ক্রেডিট লাইনের শেষ লাইনটি চূড়ান্ত হওয়ার পরই চলচ্চিত্রটি পথ চলার যোগ্যতা অর্জন করে।

সবেমাত্র হাঁটতে শেখা শিশুটি জানে না তার গন্তব্য কোথায়? সে কখনও মা-বাবা, ভাই-বোন কিংবা তার চেনা মুখ গুলোর কাছে ছুটে যায়। আবার কখনও কখনও অভিভাবকদের অসচেতনতায় বিপদগামীও হয়। একই ভাবে নির্মাতা কিংবা প্রযোজকের অসচেতনতাও একটি চলচ্চিত্রের পথ চলাকে বিপদগামী করতে পারে। আর তাই চলচ্চিত্রটির নিরাপদ পথ চলা নিশ্চিত করতে সম্পাদনার কাজ চলা অবস্থায় কিংবা শেষ হওয়ার পর হতে পারে চলচ্চিত্রটির পরিবেশনা এবং বিপণন পরিকল্পনা।

চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক সময় স্বল্পদৈর্ঘ্য কিংবা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বলে আলাদা কিছু ছিল না। যে কোন  দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রকে কেবল চলচ্চিত্রই বলা হত। কিন্তু ব্যবসায়ী প্রদর্শকরা দেখল ফিল্মের দৈর্ঘ্যে বেশি এমন চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী প্রতিদিন কম সংখ্যায় করেও ফিল্মের দৈর্ঘ্যে কম এমন চলচ্চিত্রের চেয়ে বেশি মুনাফা করা যায়। তাই তারা দৈর্ঘ্যে উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্রকে আখ্যায়িত করে পূর্ণদৈর্ঘ্য এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য নামে। এরপর স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে পেক্ষাগৃহে প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়। এভাবে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র থেকে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পরিবেশন এবং বিপণনে এক কদম পিছিয়ে পরে। আঞ্চলিক বাজারে পূর্ণদৈর্ঘ্যে জন্য সম্ভাবনা থাকলেও স্বল্পদৈর্ঘ্যের বাজার একদমই নেই।

এদিক থেকে চলচ্চিত্র উৎসব গুলো উদার। তারা স্বল্পদৈর্ঘ্য এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা করে হলেও প্রদর্শনী করায়। চলচ্চিত্র উৎসব হচ্ছে চলচ্চিত্র পরিবেশণ এবং বিপণনের আর একটি বাজার। এখানে পূর্ণদৈর্ঘ্য তো বটেই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও পরিবেশন এবং বিপণন করা যায়। আবার এক একটি চলচ্চিত্র উৎসবের আছে আলাদা আলাদা বিষয়সূচী। তাই চলচ্চিত্রের সাথে মিলে যায় এমন বিষয়সূচীর উৎসবে জমা দিলে চলচ্চিত্রটির উৎসবে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

নেপালের পাটান দরবার স্কয়ারের ভিমসেন মন্দিরের পাশে।
বিশুদ্ধ শৈল্পিক চলচ্চিত্রের জন্য রয়েছে অনেক চলচ্চিত্র উৎসব। আবার শৈল্পিক চলচ্চিত্র নয় কেবল এওয়ার্ড বিক্রয় করে এমন অসংখ্য চলচ্চিত্র উৎসবও রয়েছে। তাই কোন উৎসবকেই ছোট কিংবা বড় করে দেখার আগে দেখতে হয় কার বাজার কি। বাজার ধরে রাখতে প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে এমন সব কর্মকান্ড কিংবা আচরণের ভেতর দিয়ে যেতে হয় যে তাদের নির্বাচিত এজেন্টদের সব সময়ই বলতে হয় এটাই সেরা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ।
কৈশোরে নায়ক হওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা এখনো মাঝে মাঝে দেখা দেয়।

চলচ্চিত্র উৎসব গুলোতে দুটো বিষয় থাকে একটি নগদ অর্থ পুরুস্কার আর অন্যটি হচ্ছে সম্মান। এই বাজার থেকে প্রাপ্ত সম্মান হচ্ছে অনেকটা ব্যাংকের চেকের মত। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট শাখায় গিয়ে এই সম্মান কে অর্থে রুপান্তরিত করা যায়।

বর্তমানে চলচ্চিত্রের জন্য আঞ্চলিক পেক্ষাগৃহ, চলচ্চিত্র উৎসব এই দু’টি বাজারের বাহিরেও আছে আর একটি বাজার যাকে OTT প্লাটফর্ম বলা হয়। OTT বলতে “অভার দ্যা টপ” বোঝায়। আগ্রাধিকার দেয়া কন্টেন্ট পরিবেশণ সিস্টেমকে ইন্টারনেট প্রটোকলে OTT বলে। OTT কন্টেন পরিবেশণের নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার হলেও সবচাইতে বেশি ব্যবহার হয় VOD বা ভিডিও অন ডিমান্ড ব্যবসায়।

এই ভিডিও অন ডিমান্ড প্রধানত তিনটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাজারে প্রচলিত।
১। SVOD – সাবসক্রিপশন ভিডিও অন ডিমান্ড।
২। AVOD – এডভের্টাইজমেন্ট বেজড  ভিডিও ‌অন ডিমান্ড।
৩। TVOD – ট্রানজেকশনাল ভিডিও অন ডিমান্ড।
একটি নন-ব্রান্ড চলচ্চিত্র উৎসবের ছবি। লেখকের গুরুত্ব বাড়াতে এখানে ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে। বিষয়টিকে গম্ভীর ভাবে নেয়ার প্রয়োজন নেই।
  • সাবস্ক্রিপশন ভিডিও অন ডিমান্ড-এ ক্রেতারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিক্রেতার ডিজিটাল কনটেন্ট ডাটাবেস সাবস্ক্রাইব করে। বিক্রেতা উক্ত ডাটাবেসে থাকা ডিজিটাল কনটেন্ট/চলচ্চিত্র কত ঘন্টা ক্রেতা/দর্শক দেখল তার উপর নির্ভর করে নির্মাতা/প্রযোজকে অর্থ পরিশোধ করে। পৃথিবী বিখ্যাত বড় প্রযোজনা সংস্থা গুলোর জন্য এমন ভিডিও অন ডিমান্ড লাভজনক।
  • এডভের্টাইজমেন্ট বেজড ভিডিও ‌অন ডিমান্ড-এ আলাদা ক্রেতা বলে কিছু নেই। এখানে বিজ্ঞাপণ দাতা একটি নির্দিষ্ট বাজেটের টাকা বিক্রেতাকে পরিশোধ করে বিক্রেতা দর্শকের সংখ্যা দেখিয়ে বিজ্ঞাপণ দাতার পরিশোধিত অর্থ থেকে আয় করে। বিজ্ঞাপণ দাতার বিজ্ঞাপণ গুলো যে সব ডিজিটাল ভিডিও কনটেন্ট চলার সময় প্রদর্শিত হবে বিক্রেতা উক্ত কনটেন্ট-এর ক্রিয়েটর-দের সাথে একটি অংশ শেয়ার করে। ভিডিও ব্লগার-দের জন্য এমন ভিডিও অন ডিমান্ড লাভজনক।
  • ট্রানজেকশনাল ভিডিও অন ডিমান্ড-এ ক্রেতা/দর্শক কেবল মাত্র যে ডিজিটাল কনটেন্ট/চলচ্চিত্র  দেখে কেবল মাত্র তার দর্শনী মূল্য পরিশোধ করে। বিক্রেতা কনটেন্ট ক্রিয়েটর, নির্মাতা/প্রযোজকের সাথে একটি নির্দিষ্ট পার্সেন্টেস-এর অংশীদারিত্বে চুক্তিবদ্ধ হয়। ছোট প্রযোজনা সংস্থার জন্য ট্রানজেকশনাল ভিডিও অন ডিমান্ড লাভজনক।

চলচ্চিত্র পরিবেশনা এবং বিপণন নিয়ে এই পর্বে প্রাথমিক কিছু ধারণা দেয়া হলো। এর পরের পর্ব গুলোতে থাকবে আঞ্চলিক পরিবেশনার সুবিধা-অসুবিধা, কোন কোন চলচ্চিত্র উৎসবে চলচ্চিত্র জমা দিলে কি কি সুবিধা রয়েছে? আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব গুলোতে চলচ্চিত্র জমা দেয়ার পদ্ধতি, চলচ্চিত্রের বাজার এবং সম্ভাবনা। (চলবে) চলচ্চিত্র পরিবেশনা এবং বিপণন (পর্ব-০২)

নির্মাণের কথা | প্রসঙ্গ: “পোস্টমাস্টার”

লিখেছেন | সুপিন বর্মন

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প পোস্টমাস্টার  পড়ার পর শুধু একটি মাত্র সংলাপ আমার মনের মধ্যে ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। “মিছে মায়া বাড়িয়ে কি লাভ, এ জগতে কে কার” এই সংলাপটিই আমার স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পোস্টমাস্টার  নির্মাণের চিন্তা ও চেতনার মূলমন্ত্র।

অসংখ্যবার পোস্টমাস্টার  পুনর্পাঠের পরও চিত্রনাট্য লেখার সাহস আমার হয়নি। তাই চিত্রনাট্যের প্রতিলিপি ভাবনা বুকে নিয়েই কেটে যায় দুই বছর। নির্মাণের স্বপ্ন যখন আমার অস্থিমজ্জায় তখন কে বাঁধা দিবে আমায়! একবার সাহস করেই পোস্টমাস্টার  নির্মাণের পরিকল্পনা শেয়ার করি আমার পরিচিত প্রিয় দু’জন বড় ভাইয়ের সাথে, তারা খুব করে নিরুৎসাহিত করেছিলেন।

স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা সুপিন বর্মন।

২০১৬ সালের এপ্রিলের কথা, একদিন বিকেল বেলা পোস্টমাস্টার  নির্মাণের কথাটি আবারও শেয়ার করি কবি এবং চলচ্চিত্র প্রেমী ড্যারিন পারভেজ ভাইয়ের সাথে। ড্যারিন পারভেজ ভাইয়ের আগ্রহ দেখে আমার চলচ্চিত্র নির্মাণ কাজে শতভাগ মনোবল বৃদ্ধি পেল। তিনি চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করার সম্মতি জানালেন। এরচেয়ে আনন্দ আর কিইবা হতে পারে। ব্যাস শুরু হয়ে গেল স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পোস্টমাস্টার-এর প্রি-প্রোডাকশনের কাজ।

চরিত্রের সাথে যায় এমন অভিনয় শিল্পী খুঁজছিলাম আমরা। বিশেষ করে রতন ও পিয়ন রমাকান্ত চরিত্রের জন্য আমরা কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে পিয়ন চরিত্রের জন্য নাট্যকর্মী সাদেকুর রহমান সুজন ভাইকে পেলাম আমরা। যদিও মূলগল্পে পিয়ন চরিত্রটি নেই। সুজন ভাইয়ের বিশেষ আগ্রহে বাকি কাজ গুলো করার উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। পোস্টমাস্টার চরিত্রের জন্য বিধান রায় এক বাক্যে রাজি হলেন এবং সকল ধরনের সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন।

রতনের খোঁজে দিনরাত একাকার হলো আমাদের অবশেষে একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বিধান দা নিয়ে গেলেন আমাকে। আমি নিমন্ত্রিত নই তারপরও লজ্জা ত্যাগ করে রিয়া নামের ছোট্ট মেয়েটির জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাই। প্রথম দেখাতেই রিয়াকে পছন্দ হলো রতন চরিত্রের জন্য। বিশেষ করে রিয়ার চোখ ও কোঁকড়ানো চুল ঠিক যেন রতনকে চোখের সামনে জীবন্ত দেখতে পাচ্ছি।

"মজার বিষয় হলো শুভ মহরতের আগের রাতেই আমাদের প্রযোজক নিখোঁজ হলেন। কোনভাবেই তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেলোনা। মনটা ভীষণ খারাপ হলো আমার। কোনভাবেই আমরা শুভ মহরত করতে পারলাম না।"

অনুষ্ঠান শেষে বিধান দার মাধ্যমে রিয়ার মার কাছে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পোস্টমাস্টার-এ রতন চরিত্রে রিয়ার অভিনয়ের অনুমতি চাই। তিনি তখনই অনুমতি দিলেন। বলা যায় মুখ্য চরিত্র তিনটির জন্য আমাদের দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেলো। অন্যান্য চরিত্রগুলো খুব সহজেই পেয়ে গেলাম। তাই বেশ আনন্দ নিয়েই শুরু হলো লোকেশন নির্বাচনের মত জটিল কাজ।

সারাদিন মোটর সাইকেল নিয়ে বগুড়া জেলার এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে আমরা যাইনি। সারাদিন লোকেশন খুঁজে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আবার নিয়মিত রিহার্সেলের কাজও চলতো। এভাবেই মোটামুটি একটি মাস বেশ ধুমধাম করে চললো আমাদের। অবশেষে লোকেশনও চূড়ান্ত হলো আমাদের।এইবার সকল প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ পূর্বক সকলের সম্মতিক্রমে শুটিং-এর তারিখ চূড়ান্ত করা হলো কিন্তু তার আগে প্রযোজকের ইচ্ছায় শুভ মহরত অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। যথারীতি শুভ মহরতের জন্য সময় ও তারিখ নির্বাচন করা হলো। মজার বিষয় হলো শুভ মহরতের আগের রাতেই আমাদের প্রযোজক নিখোঁজ হলেন। কোনভাবেই তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেলোনা। মনটা ভীষণ খারাপ হলো আমার। কোনভাবেই আমরা শুভ মহরত করতে পারলাম না।

গোছানো পুরো টিম এলোমেলো হয়ে গেলো হতাশায়। কাজটি শেষ পর্যন্ত হবেনা ভেবে সকলেই কষ্ট পেলেন। আমি সকলকে আশ্বস্ত করলাম যে এতগুলো টাকা যখন খরচ হয়েছে তখন কাজ হবেই। আমি শুটিং-এর তারিখ কোন ভাবেই পরিবর্তন করলাম না। হাতে সময় রইলো মাত্র ৫দিন। এর মাঝেই টাকা কিভাবে সংগ্রহ করা যায় তার হিসাব কষতে লাগলাম। ফোন করে করে কারও কাছে তেমন আশার বাণী শুনতে পেলাম না ঠিক এমন সময়ে দিশারী উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক বন্ধুসম বড় ভাই এম রহমান সাগর সহযোগিতার হাত বাড়ালেন। ৫০% খরচের টাকা তিনি দিতে চাইলেন। সকলের ভিতর নতুন করে প্রাণ ফিরে এলো।

পোশাক নিজেরাই বানিয়ে নিলেন অভিনয় শিল্পীরা। আমার মাথায় তখনও প্রচন্ড চাপ। বাকি টাকাটা আসবে কিভাবে? এদিকে ঢাকার ক্রু মেম্বারদের চূড়ান্ত তারিখ দিয়েছি।

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পোস্টমাস্টার-এর একটি দৃশ্য।

"রাতে মায়ের কাছে ফোনে কথা বলে তার শখের সোনার কানের দুল বানানোর জন্য জমানো সব টাকা নিয়ে নিলাম শীঘ্রই ফিরে দিব এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে। আজও মাকে দেয়া সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারিনি।"

দিন ঘনিয়ে আসছে, এদিকে দুশ্চিন্তায় আমার মাথা ব্যথা বাড়তে থাকে। অবশেষে কাউকে সহ প্রযোজনার কাজে না পেয়ে বেশ মর্মাহত হলাম। রাতে ঢাকা থেকে শুটিং ইউনিট রওনা হয়েছে। সকালে বগুড়া পৌঁছলেই পরশু থেকে শুটিং। কি এক অস্বস্তিকর সময়! রাতে মায়ের কাছে ফোনে কথা বলে তার শখের সোনার কানের দুল বানানোর জন্য জমানো সব টাকা নিয়ে নিলাম শীঘ্রই ফিরে দিব এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে। আজও মাকে দেয়া সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারিনি।

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পোস্টমাস্টার-এর শুটিং এর একটি মুহূর্ত।

যথারীতি বগুড়ায় পৌঁছে গেল টিম। লোকেসনে চলে গেল শুটিং ইউনিট। কাল সকাল থেকে শুটিং বলে কথা।  তাই সকল টেকনিক্যাল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে আজই সমাধান করতে হবে। লোকেশনে পৌঁছলাম আমরাও। যে বাড়িটি আমরা ঠিক করেছিলাম সেই বাড়ির মালিক হঠাৎ বিগড়ে বসলেন। তিনি আর তার বাড়িটিতে কোনভাবেই শুটিং করতে দেবেন না। এইবার রীতিমত মাথায় বাজ পড়লো। সবাই হতবাক। কি হবে এখন। নতুন করে বাড়ি খুঁজে পাওয়া সহজ বিষয় না। এইবার লোকেশন সংকটে পোস্টমাস্টার টিম।

তিন ভাগে তিনটি টিম বেড়িয়ে পড়লাম আমরা লোকেশনের খোঁজে। শুটিং করতেই হবে এই পণ করেছি আমরা। ঠিক সন্ধ্যার আগে বিধান দা ও সুজন ভাই একটি আশার বাণী শোনালেন। সুজন ভাইয়ের গ্রামের বাড়িতে একটি পরিত্যাক্ত মাটির ঘর আছে, পাশের গ্রামটিও বেশ মনোরম রয়েছে।

সন্ধ্যায় দ্রুত সেখানে টিম নিয়ে চলে যাই আমি। কোনরকম বাড়িটিকে শুটিং উপযোগি করা হলো। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। ঢাকা থেকে টিম এসে বসে থাকা মানেই আমার বাজেট বেড়ে যাওয়া, এমনিতেই বাজেট স্বল্পতা রয়ে গেছে। পরিশেষে ধুমধাম করে তিনদিনের শুটিং দুদিনেই টেনে হেঁচড়ে শেষ করতে হলো টাকার সংকটের কারণে।

পোস্টমাস্টার-এর ফুটেজ পেয়ে কিছুটা স্বস্তি এলো মনে। যদিও মনের মত করে শুট করতে পারিনি আমরা। লোকেশন পরিবর্তন না হলে কিংবা শুটিং শেষ করার প্রয়োজনীয় অর্থের সংকুলান থাকলে মনের মত করে পোস্টমাস্টার চলচ্চিত্রটি হয়ত দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা যেত। তারপরেও এত সংকট ও সমস্যা মোকাবেলা করে পোস্টমাস্টার যে আলোর মুখ দেখেছে সে জন্য আমি টিমের সকলের কাছে কৃতজ্ঞ।

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পোস্টমাস্টার  নির্মাণ আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। চলচ্চিত্রটি নির্মিত না হলে হয়ত আমার নির্মাণের পথে পথ চলা শুরুই হত না।